দিবসটিকে সুসম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় উপজেলা প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুুতি গ্রহণ করেছেন। এলাকায় সাজসাজ রব পড়েছে। বসতবাড়িটি সেজেছে বর্ণিল সাজে। প্রায় ২শত বছর পুরনো জরাজীর্ণ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর বাড়িটিতে এখন প্রবেশ করলে মনে হবে ফিরে এসেছি শত বছর পুরনো কোনো রাজপ্রাসাদে। মনোরম পরিবেশ, দৃষ্টি নন্দন কাঠামো ও পারিপার্শ্বিক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে সকলে হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। বসতভিটায় সুদৃশ্য বৃহৎ প্যান্ডেল, সড়কের উপর পিসি রায় তোরণ, প্যানা ফেস্টুনে সুসজ্জিত। করা হয়েছে ব্যাপক প্রচার প্রচারনা। সোমবার উপজেলা মিলনায়তনে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় ও প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়।
জন্মজয়ন্তী কে সাফল্যমন্ডিত করতে দফায় দফায় পরিদর্শন করেছেন, এমপি বাবু, উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু,ইউএনও মমতাজ বেগম, এ্যাসিল্যান্ড এম. আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ আহমেদ, ওসি মোঃ জিয়াউর রহমান, আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সুশীল সমাজ সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ।
সেজন্য সবুজ বৃক্ষে ঘেরা দৃষ্টি নন্দন বাড়িটি জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সেজেছে অপরূপ সাজে। ২ আগস্ট আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ঐদিন বিকাল সাড়ে ৩টায় পিসিরায়ের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি পরিদর্শন, আলোচনা সভা, পিসি রায়ের জীবন ও কর্মেরর ওপর তথ্যচিত্র প্রদর্শন, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ক উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ ও সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ (এমপি)। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন, খুলনা জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা)'র সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু, পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান। এছাড়া প্রতিমন্ত্রীর সফরসঙ্গী একান্ত সচিব মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম।
রসায়নবিদ, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক ও কবি আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষের তীরে রাডুলি গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মা ভূবনমোহিনী দেবী এবং পিতার হরিশচন্দ্র রায়ের পুত্র। হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় জমিদার ছিলেন। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় ছিলেন।
তার পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশায় রোগের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। গ্রামে থাকার এই সময়টা তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই পান তিনি এবং বইপাঠ তার জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করে।
১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতায় ফিরে যেয়ে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সকুল ফাইনার তথা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফএ পরীক্ষায় (ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন।
পরবর্তীকালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ডিএসসি ডিগ্রি লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তার সেই গবেষণার বিষয় ছিল কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণির সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এমনকি তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে এবং ভারতবিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে সাড়া ফেলে দেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন।
অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্য নতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান। তার উদ্যোগে তার নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড।
১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
১৯০৩ সালে চারটি গ্রামের নাম মিলে বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় দক্ষিণ বাংলায় প্রথম আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন। একইস্থানে স্যার পিসি রায়ের পিতা উপমহাদেশে নারী শিক্ষা উন্নয়নকল্পে ভূবনমোহিনীর নামে ১৮৫০ সালে রাড়ুলী গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনসক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়েরজন্য তিনি বিপ্লবীদেরসাহায্য করেন। ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
শিক্ষকতার জন্য তিনি সাধারণ্যে ‘আচার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত। ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের মতো তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সিআইই লাভ করেন। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের মত মহাত্মা গান্ধীর জনসভা আয়োজন করেছিলেন।
বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে তিনি পিসি কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে বিশাল ভূমিকা রাখছে। ১৯১৯ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নাইট উপাধি লাভ করেন।
১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষের মহিশুর ও বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
এছাড়া ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট পান।
এছাড়া মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও নাইট উপাধি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন ৮২ বছর বয়সে কোলকাতার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জীবনাবসান ঘটে চিরকুমার বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। এই বিজ্ঞানী তার জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি মানব কল্যাণে দান করে গেছেন। এই কৃর্তিমান মহাপুরুষের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেন করি।


0 coment rios: