খুলনার কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর চরে খাসজমিতে ঘর তুলে বাস করেন কার্তিক মুন্ডা। ঘর বলতে গেওয়া গাছের চারটি নড়বড়ে খুঁটির ওপর গোলপাতার ছাউনি। সে ছাউনি দুর্বল হয়ে নুয়ে পড়েছে মাটিতে। তাতে পলিথিন দিয়ে বৃষ্টির পানি ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বৃষ্টির পানি কোনো রকমে ঠেকানো গেলেও জোয়ার হলে ঘরের বারান্দা অবধি চলে আসে নদীর পানি।
খাবার জোগাড় করতে অনেক কষ্ট, ঘর ঠিক করবো কেমনে |
কার্তিক মুন্ডা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এভাবে। খাবার জোগাড় করতিই অনেক কষ্ট; ঘর ঠিক করব কেমনে? শুনিচি, সরকার গরিব মানষির জন্যি পাকা ঘর দেছে। এলাকার অনেকেই সে ঘর পাইছে। চিয়ারমেন-মেম্বরের কাছে ঘরের জন্যি অনেক হাঁটাহাঁটি করিছি। কিন্তু আমাগের ভাগ্যে তা জুটিনি।’
পাশে থাকা কার্তিক মুন্ডার স্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাগের কথা কেউ ভাবে না। ভগবানই জানে, আমরা কেমন আছি।’
কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর কয়রা গ্রামে ওই সম্প্রদায়ের ৪৫টি পরিবারের ২০৯ জনের বসবাস। তাদের বেশিরভাগই ভূমিহীন। চরের জমিতে ঘর তুলে বাস করেন তারা। আবার দু’একটি পরিবারের ভিটেবাড়ি থাকলেও ফসলি জমি নেই। তাই সংসার চালাতে পরিবারের নারী-পুরুষ সবাইকে দিনমজুরি করতে হয়। তবে করোনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে এলাকায় কাজ না থাকায় আদিবাসী পরিবারগুলোতে অভাব-অনটন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে কাজের সন্ধানে কেউ কেউ এলাকা ছাড়ছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
বড়বাড়ি গ্রামের বলয় কৃষ্ণ জানান, উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১২টি গ্রামে মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের ৩৪০ পরিবারের ১ হাজার ২৫০ জন বসবাস করছে। এক সময় কৃষিই ছিল এসব পরিবারের জীবিকার প্রধান উপায়। চিংড়ি চাষের কারণে এলাকায় কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে এসব পরিবারের সদস্যরা। এখন বেশিরভাগ পরিবারের প্রধান পেশা সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া শিকার। তবে সরকার জেলেদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিলেও তাদের সম্প্রদায়ের কেউই সে সুযোগ-সুবিধা পায় না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
নলপাড়া গ্রামে মুন্ডা সম্প্রদায়ের ২৮টি পরিবারে ১৩৪ জন বসবাস করে জানিয়ে ষাটোর্ধ্ব হীমনাথ মুন্ডা বলেন, গ্রামে অনেকেই বয়স্ক ও বিধবা ভাতা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু চারজন ভাতা আর একজন মাত্র ৩০ কেজি (ভিজিএফ) চাল পায়। অভাব-অনটনের কথা মেম্বারকে বললেও গুরুত্ব দেন না বলে অভিযোগ তার।
কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৭শ পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১০ পরিবারকে আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে পরিবারগুলোকে।
২ নম্বর কয়রা গ্রামের সাধনা মুন্ডা বলেন, ‘কেন জানি না আমরা বরাবরই সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকি।’ তিনি জানান, তাদের এ গ্রামের ২৫টি পরিবারের মধ্যে ২ জন বয়স্ক ভাতা, ১ জন বিধবা ভাতা ও একজন ভিজিএফ সুবিধা পাচ্ছেন। করোনাকালীন সরকারি প্রণোদনার টাকার জন্য আমাদের অনেকের নামের তালিকা করা হলেও সব মিলিয়ে ১০টি পরিবার এ সুবিধা পেয়েছে। তা ছাড়া ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর কিছু শুকনা খাবার ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
কয়রার ইউএনও অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা তালিকা অনুযায়ী উপকারভোগী নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অনেক সময় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বাদ পড়েন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য আলাদা বরাদ্দ না থাকায় তাদের সেভাবে সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা যায় না। তবে স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর নিয়ে তাদের সহযোগিতায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনতে ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাদের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী এবং উপজেলা পরিষদ থেকেও সরকারি সুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়। তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে- এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।
0 coment rios: